এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে আমি ও আমার স্ত্রী ক্যান্স (Cairns) ভ্রমণে গিয়েছিলাম। ট্রিপের প্রথম অংশ কিছুদিন আগেই ঘুরুঞ্চির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। এবার দ্বিতীয় খন্ডে সবাইকে আমন্ত্রণ জানাই। প্রথম পর্বে আমি লিখেছিলাম ডেইনট্রি ফরেস্ট নিয়ে। এবারের পর্বে আমি লিখব ব্যারন নদীতে (Barron River) হোয়াইট ওয়াটার রাফটিং নিয়ে। আমাদের ট্রিপের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর দুটি দিনের মধ্যে রাফটিং ছিল অন্যতম। আরেকটি ছিল স্নোরকেলিং; যেখানে আমি পেট ভরে সমুদ্রের নোনা জল খেয়েছিলাম। সাঁতার না জানাই ছিল এর মূল কারণ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিষয়টি আমি খুব একটা উপভোগ করিনি। রাফটিংয়ে নোনা জল নেই আর গভীরতা ও কম। তাই জল দিয়ে পেট ভরার সম্ভাবনা ও নেই। পরাজয়ে ডরে না বীর; কিন্তু আমি সে বীর নই। খুব ভীতু প্রকৃতির মানুষ আমি। বেশিরভাগ ডেয়ারডেভিল একটিভিটি থেকে দূরে থাকি। কিন্তু রাফটিং এর ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় ও উত্তেজনায় ভরপুর হওয়ার কারণে এটা আমার সবচেয়ে পছন্দের একটিভিটি গুলোর একটি। ২০১২ সালে লাদাখে (Zanskar) নদীতে প্রথমবারের মতো হোয়াইট ওয়াটার রাফটিং করার সুযোগ মিলে। সেই রোমাঞ্চের কথা আমি কখনোই ভুলবো না। এরপর থেকে যখনই সুযোগ এসেছে আমি রাফটিং করেছি। এই পর্বে রাফটিং সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, কৌশল ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আপনাদের সাথে আলাপ করব।

আমরা যেই কোম্পানির মাধ্যমে রাফটিং করেছিলাম তারা আমাদেরকে ক্যান্স শহর থেকে বাসে করে বেইসক্যাম্প-এ (যেখান থেকে রাফটিং শুরু হবে) নিয়ে যায়। নারী-পুরুষ মিলিয়ে আমরা প্রায় ৫৫ থেকে ৬০ জন অংশ নিয়েছিলাম। অংশগ্রহণকারীদের বয়স আনুমানিক ১৮ থেকে ৫৫ ছিল। প্রতিটি রাফট এ পাঁচ থেকে ছয় জন করে ছিল। সব রাফট- এর সাথে একজন করে অভিজ্ঞ গাইড ছিলেন। রাফটিং এর শুরুতেই গাইড আমাদের সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কখন কি করতে হবে। বিভিন্ন কোড ওয়ার্ড আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এক একটি শব্দের অর্থ হচ্ছে এক একটি বিশেষ কাজ। সামরিক প্রশিক্ষণের মতো মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা। অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলো শব্দ মাথায় রাখা কিছুটা শক্ত কাজ। আর মনে রাখতে না পারলেও কোন সমস্যা নেই। পুরো বিষয়টাই ছিল বেশ মজার। প্রতিটি গাইডই তার নিজস্ব টিম মেম্বারদেরকে খুব মজা করে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন। জরুরী সময়ে কিভাবে নিজের বা অন্যের জীবন বাঁচাতে হবে তা সম্পর্কে ও বর্ণনা দেন। আমাদের প্রত্যেকের সাথে একটি করে হেলমেট, লাইফ জ্যাকেট ও প্যাডেল ছিল। আর পরণে পানি উপযোগী পোশাক ছিল। পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে আমরা আগে থেকেই রাবারের স্যান্ডেল (crocs জাতীয়) পড়ে গিয়েছিলাম, যেগুলো পা থেকে সহজে খুলে আসবেনা। যেহেতু এটা গ্রেড ৩ মানের রাফটিং তাই এটা সব বয়সী ও শারীরিক সামর্থ্যের মানুষের জন্যই (১৫ থেকে ৬৫) উপযোগী। তবে সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ আপনার নিজের। সাঁতার না জানলেও চলবে। যেমন আমি নিজেই খুব একটা সাঁতার পারি না। তবে জানা থাকলে ভালো। মাঝে মাঝেই রাফট উল্টে যায়। তখন সাঁতার জানা থাকলে কিছুটা কাজে আসে। তবে ওই রকম খরস্রোতা নদীতে সাঁতারের চেয়েও ভালো কাজে দিবে গাইডের বর্ণনা করা নিয়ম নীতিগুলো। প্যানিক না করে একটু মাথা খাটিয়ে আপনি খুব সহজেই নিজেকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যেতে পারবেন।

আমরা যখনই কঠিন কোন বাঁক পার হচ্ছিলাম বা র‍্যাপিড (বিশালাকার ঢেউ) অতিক্রম করছিলাম তখনই মনে হচ্ছিল এই বুঝি রাফট থেকে ছিটকে পড়ব। আগের দিন প্রবল বৃষ্টি হওয়াতে নদীর পানি কিছুটা উত্তাল ছিল। যা আমাদের অভিজ্ঞতাকে আরো রোমাঞ্চকর করে তুলেছিল। নদীর পানি উত্তাল থাকায় টুর অপারেটররা বেশ সতর্ক ছিল। বেশ কিছু বাঁকে সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য একটি একটি করে রাফট পার হচ্ছিল। একটা পর্যায়ে তো প্রতি রাফট-এ দু’জন করে গাইড বরাদ্দ করা হলো। তারপরও সবাই মিলে বিশেষ পয়েন্টটি পার হতে গলদঘর্ম হতে হলো। গাইড এর নির্দেশনা অনুযায়ী রাফট-এ সবাই মিলে জোরে জোরে লাফালাফি শুরু করলাম; জায়গায় বসে থেকেই। তাতেও খুব একটা সুবিধা হচ্ছিল না। একটি বিশাল পাথরের উপর আমাদের রাফট আটকে গিয়েছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই আটকে পড়াতে কারোরই কোন খারাপ লাগা নেই; বরং উল্টোটা। সবাই বিপুল উৎসাহে রাফট-এর উপর বিভিন্ন কসরত শুরু করলো। বেশ কিছুক্ষণ পরে আমাদের সকলের প্রচেষ্টা সফল হল। আমরা সেই বাঁক থেকে বেরিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম বাকি সবার পৌঁছাবার জন্য। আমাদের মত সকলকেই ওই একই কসরতের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে। ওই বাঁক পার হবার পরে সকলেই বুনো উল্লাসে ফেটে পড়লো। লিখে এই অ্যাড্রিনালিন রাশের ব্যাপারটা প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

এভাবে আরো বেশ কয়েকটি বাঁক ও র‍্যাপিড পার হলাম। একেকটি বাঁকে একেক রকমের চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধকতা ছিল। প্রতিটি র‍্যাপিড-এর আবার নামও ছিল। নামগুলো বেশ মজার মজার। এরমধ্যে একটির নাম ছিল “Cheese-Churner”। নামকরণের পিছনে বিশেষ কোনো কারণ নেই; নিছক খেয়ালবশত এরকম নামকরণ। আমাদের রাফটিং এর ব্যাপ্তি ছিল প্রায় দেড় ঘন্টা। পুরো সময় জুড়েই আমাদের গাইড মজার মজার সব তথ্য দিয়ে গিয়েছেন যার বেশিরভাগই ব্যারন নদী, ক্যান্স, নদীর পার জুড়ে রেইন ফরেস্ট ও নদীতে থাকা কুমিরকে ঘিরে। ভয় পাবেন না, নদীর যে অংশে আমরা রাফটিং করেছিলাম সেখানে খুব একটা কুমিরের আনাগোনা নেই বললেই চলে। আমাদের রাফটিং শেষ হয়েছিল “Lake Placid” নামক একটি অংশে এসে যেখানে নদী অনেকটাই শান্ত। এর পরের অংশটাই কুমির দিয়ে ভরপুর ছিল। খাবারের অভাব দেখা দিলে মাঝে মধ্যেই কুমিরের বাচ্চারা এই “Lake Placid” -এ ও চলে আসে। ভেবে দেখুন তো, ব্যাপারটা বেশ রোমাঞ্চকর না! যখন আমরা তীরে পৌঁছালাম, সবাই মিলে রাফট মাথায় করে বেশ খানিকটা এগিয়ে দিলাম; আর এটাই রীতি। আর এখানেই আমাদের রাফটিং এর ইতি।

লেখার শেষ পর্যায়ে আমি কিছু টিপস আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই। যারা কখনো রাফটিং করেননি বা খুব শীঘ্রই রাফটিং করার প্ল্যান করছেন আশা করি তাদের বেশ কাজে আসবে।

  • পানি উপযোগী পোশাক পড়বেন। পোশাক আরামদায়ক হওয়াটা খুব জরুরী। খুব বেশি ঢিলেঢালা পোশাক থেকে বিরত থাকবেন। একটিভ ওয়্যার বা সুইমওয়্যার এক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযোগী পোশাক। রাবারের স্যান্ডেল সাথে নিবেন যা কিনা পায়ের সাথে শক্ত করে লেগে থাকে। রাফটিং শেষে ভেজা কাপড় খুলে শুকনো কাপড় পড়ে নিতে হয় খুব দ্রুত। তা না হলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। তাই অবশ্যই এক সেট শুকনো কাপড় সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। সাথে বড় একটি টাওয়েল রাখার চেষ্টা করবেন, এর উপকারিতা সময় হলেই বুঝতে পারবেন।
  • আপনি যদি পাওয়ার এর চশমা পড়েন তাহলে লক্ষ্য রাখবেন তা যেন খুলে না যায়। চিন্তার কিছু নেই, সাধারণত টুর অপারেটরদের কাছে এ সংক্রান্ত কিছু ব্যবস্থা থাকেই। যেমন আমি আমার পাওয়ারের চশমা পড়েই রাফটিং শেষ করেছিলাম। কোন সমস্যা হয়নি।
  • হেলমেট ও লাইফ জ্যাকেট আপনার শরীরের সাথে যেন ভালো ফিটিং হয় সেটা লক্ষ্য রাখবেন। খুব ঢিলেঢালা বা খুব টাইট যেন না হয়। খুব টাইট হলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এটা অবশ্য টুর অপারেটররা খুব ভালো করে নজর দেয়।
  • খুব ভরা পেটে এ ধরনের অ্যাক্টিভিটিতে না যাওয়াটাই ভালো। আবার একেবারে খালি পেটে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। রাফটিং এর ঘন্টা দুয়েক আগে প্রোটিন জাতীয় খাবার খাওয়া দরকার। শর্করা জাতীয় খাবার কম খাওয়াই ভালো। যেহেতু রাফটিং অনেক পরিশ্রমের কাজ ও রাফটিং চলাকালীন উত্তেজনা আপনাকে অনেক ক্লান্ত করে তুলতে পারে, তাই সাথে করে কিছু শুকনো খাবার রাখার চেষ্টা করবেন।
  • রাফটিং এর শুরুতে বাথরুম সেরে নিতে ভুলবেন না। বলার অপেক্ষা রাখে না, শুনতে বেশ তুচ্ছ ও হাস্যকর মনে হলেও এটা আপনাকে রাফটিং চলাকালে অনেক সাহায্য করবে।

যারা কখনোই রাফটিং করেননি তাদের উদ্দেশ্যে বিশেষ অনুরোধ থাকবে জীবনে একবার হলেও এই অভিজ্ঞতা নিবেন। মনে রাখবেন আমার মত ভীতু মানুষ যদি রাফটিং করতে পারে তাহলে আপনিও পারবেন। সবাই সুস্থ থাকবেন ও ভালো থাকবেন।