বান্দরবান-মিজোরাম-মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে (উড়তে উড়তে) হটাৎ নজরে এলো জায়গাটা। আর কিছুক্ষন আগে এক পশলা বৃষ্টি হবার ফলে চারিদিক চকচকে ছিল। অনেক উঁচু উঁচু পাহাড়ের মাঝে শুয়ে আছে অদ্ভুত একটা লেক। পশ্চিম এবং দক্ষিন দিকে একটু সমতল মনে হলেও উত্তর ও পূর্ব দিকে খাড়া দুর্ভেদ্য পাহাড়। এর মাঝেই উত্তর-দক্ষিন দিকে শুয়ে আছে টলটলে জলের শান্ত এক জলাধার। চারিদিক সবুজের মাঝে ঘন-নীল পানি খুব চোখে লাগার মতো। পশ্চিম পাড়ের মাঝামাঝি বিশাল এক একলা তালগাছ। আর আশে পাশে কোথাও কেউ নেই। কেমন যেন বিষন্নতায় ছেয়ে আছে চারপাশের বিশাল এলাকাটা।

ম্যাপ বের করে দেখি এটা বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার সীমান্তে এবং রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার অধীনে পুকুর পাড় এলাকায়। লেকের নাম রাইক্ষ্যং। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক লেক যা আকারে বগা লেকের চেয়ে প্রায় ৬/৭ গুন বড়। কিন্তু সৌন্দর্যে হাজার গুনে। এতো সুন্দর জায়গা অথচ নামই শুনিনি অথবা সোশ্যাল মিডিয়াতে শুধু বগা লেকের নাম করতে সবাই পাগল। ব্যাপারটা কেমন যেন। সেই সাথে ঐ বিষন্নতা ভাবটা আমাকে ছেয়ে আছে। ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম আমার মোবাইলে। 
দু একজন বন্ধুর সাথে কথা বলতেই বিষন্নতার কারন খুঁজে পেলাম। গত ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২২ তারিখে লেকের কাছাকাছি একজায়গায় সন্ত্রাসীদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার হাবিবুর রহমান শহীদ হন। তিনজন সন্ত্রাসী নিহত হবার পাশাপাশি বিপুল পরিমান গোলাবারুদ উদ্ধার হয়।এর মানে হলো এই এলাকা বেশ দুর্গম এবং প্রতিকূল হবার কারনে পর্যটকদের জন্য খুব অনিরাপদ।

২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর রাইক্ষ্যং পুকুর পাড়ার কাছ থেকে অপহৃত হন ঢাকার মিরপুরের পর্যটক জাকির হোসেন মুন্না ও আবদুল্লাহ আল জুবায়ের এবং গাইড মাংসাই ম্রো। অপহরণকারীরা নিজেদের মিয়ানমারের আরকান লিবারেশন পার্টি (এএলপি) পরিচয় দিয়ে অর্ধ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। তাদের উদ্ধারে ১৬ অক্টোবর সীমান্তে যৌথবাহিনী সঙ্গে সন্ত্রাসীদের ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনায় উভয়পক্ষের দুইজন নিহত ও আরও দুই জন আহত হয়। উদ্ধার করা হয় অস্ত্র, গোলাবারুদ। এরপর দফায় দফায় অভিযানের পরও আজ পর্যন্ত অপহৃতদের কোনও হদিস পাওয়া যায়নি।
 
এছাড়াও এই লেক (এবং বগা লেক) নিয়ে স্থানীয় বা উপজাতিদের মাঝে ব্যাপক শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভীতি আছে যেখানে এসব লেক দেবতার পুকুর বা ড্রাগনের আবাস বলে মনে করে। এতে আমার জানার আগ্রহ বেড়ে গেলো এবং ইন্টারনেট ঘেটে আমি আরো কিছু চমৎকার তথ্য পেলাম যা আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।

  • রাইক্ষ্যং লেক হলো ভারত-মায়ানমার সীমান্তে প্রায় ১,২০০ ফিট উচুতে ১০০ একর ব্যাপি একটা প্রাকৃতিক জলাশয় যা বগা লেকের উত্তর পুর্বে ১২ ঘন্টার পথ এবং প্রায় ৬ গুন বড়। এর সর্বনিম্ন গভীরতা প্রায় ১০০ ফিট। এর প্রায় চারিদিক উঁচু পাহাড়ের কারনে এখানে জনবসতি খুব কম। ফলে লেকটি শত শত বছর ধরে শীতল টলটলে জলের আঁধার। এখানে শিং মাছ সহ অনেক ধরনের মাছ পাওয়া যায়।
  • রেডিও কার্বন ডাটা এনালাইসিস করে জানা যায় যে বগা লেক সৃষ্টি হয়েছে ১৭২৩-১৭৯৭ সালে এবং রাইক্ষ্যং লেক তৈরী হয়েছে ১০২৩-১১৫৪ সালের মাঝে।
  • ড্রাগন হোক বা দেবতা হোক, এই লেকদুইটির উৎপত্তি ক্রেটার বা আগ্নেয়গিরি’র ফসল ভাবা হলে এসব লেক (বিশেষত বগা লেক) এর তলদেশে Trunk বা গাছের গুড়ি পাওয়া গেছে। এর মানে হলো ভুমিকম্পের কারনে ভুচ্যুতি ঘটলে এবং ভীষন বৃষ্টিপাতের ফলেই এই লেক দুটির সৃষ্টি। শরীফ সারোয়ার নামে এক স্কুবা ডাইভার বগা লেকের তলদেশ ঘুরে এসেছেন।
  • বগা লেক বছরে ২.৩৩ মিমি এবং রাইক্ষ্যং লেক বছরে 0.৫ মিমি করে ভরে যাচ্ছে (Sedimentation) যা মুলত পাহাড়ি ঢল ও মানুষ জাতির কল্যানে। এভাবেই বাং পুকুর, চিংড়ি ও রিলিত পুকুর ভরে গেছে ।
  • মজার ব্যাপার হলো পার্বত্য চট্রগ্রামে আরো কিছু এলাকায় লেক বা জলাশয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। এজন্য বিশেষজ্ঞগন ২৭ জুলাই ২০০৩ সালে বরকল ভুমিকম্প (৫.১ ম্যাগনিচিউড) কে দায়ী করছেন। ঐ ভুমিকম্পে বিভিন্ন এলাকায় গভীর খাদের সৃষ্টি হয়েছে এবং অতিবৃষ্টি থেকে পাহাড়ি ঢলের কারনে এসব এলাকায় স্থায়ী ভাবে জলাশয় গড়ে উঠছে। এমন দুটি লোকেশন হচ্ছে বগা লেক থেকে ৬ কিমি উত্তরে বা রাইক্ষ্যং লেক থেকে ৭ কিমি পূর্বে।

এখানে ২টি ভবিষ্যতে সম্ভাব্য লেকের লোকেশন দেখানো হয়েছে যা উভয় দিক থেকে ব্যাপক ভু-আন্দোলনের কারণে এবং ভ্যালির শেষভাগে সমাপনী বিন্দুতে ভূমিধস সৃষ্ট বাঁধ দ্বারা হ্রদ অববাহিকাকে বিচ্ছিন্ন করে উপত্যকা বন্ধ হওয়ার কারণে তৈরী হতে পারে।

Reference:

Islam S, Debnath P and Garnier J (2017) An Approach to the Origin of Boga Lake and Pukurpara Lake in the Hill Districts of Bangladesh, Oriental Geographer, vol.58, no.2, pp.31-52

 আজ অনেক হলো। রাইক্ষ্যং লেক এর সুন্দর একটা ভিডিও করেছি যা আরো ডিটেইলস তথ্য সহ প্রকাশ করবো। ফলে আপনারা এই জনমে যেতে না পারলেও দেখার সুযোগ পাবেন। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
 
পুনশ্চঃ
জাকির হোসেন মুন্না, আবদুল্লাহ আল জুবায়ের এবং গাইড মাংসাই ম্রো আজ প্রায় আট বছর ধরে নিখোঁজ। এডভেঞ্চারপ্রিয় এসব মানুষ একদিন ফিরে আসবেন বলে আশায় থাকলাম।

পড়ুন সোহেল রানার আরো লেখা

বগা লেকের আসাধারণ ছবিটির বিনা শর্তে ব্যাবহারের অনুমতি দেবার জন্য হণ্টক রিপনের (Md Akram Hossain) কাছে ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিন টীম কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ হলো।

 

ঘুরুঞ্চি ম্যাগাজিনের সকল কর্মকান্ড নট ফর প্রফিট, স্বেচ্ছাসেবকদের অংশগ্রহণে সকল কাজ পরিচালিত হচ্ছে।

অত্যন্ত ভরাক্রান্ত মনে জানাতে হচ্ছে যে আমাদের সম্মানিত লেখকদের জন্য কোনো তহবিল এই মুহূর্তে আমাদের কাছে নেই। অদূর ভবিষ্যতে তহবিল গঠন করতে পারা গেল এই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে।

 

ঘুরুঞ্চির ওয়েবসাইট পরিচালনা করতে আমাদের সপ্তাহে ৮-১২ ঘন্টা কাজ করতে হয়। বর্তমানে আমাদের কাজ শুধুমাত্র স্বেচ্ছাসেবক এবং স্ব-অর্থায়নের উপর নির্ভর করে। আপনারা ঘুরুঞ্চিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে, অনুদান দিয়ে, স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে সাহায্য করতে পারেন।

ঘুরুঞ্চির ভ্রমণ ছবি ব্লগের ছবি থেকে আপনার পছন্দসই ছবি পেপার প্রিন্ট, ফাইন আর্ট প্রিন্ট, ওয়াল আর্ট এবং ডেস্ক আর্ট হিসাবে কেনার ব্যবস্থা রয়েছে। আপনারা ছবি কেনাকাটা করলে আমরা অল্প পরিমাণ কমিশন পাব, যা ঘুরুঞ্চির ক্রমবিকাশ এবং সম্প্রসারে ব্যাবস্থার হবে, যা ঘুরুঞ্চির ক্রমবিকাশ এবং সম্প্রসারে ব্যবহার হবে।

আমরা আপনার সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞ।